Friday, February 15, 2013

শাহবাগ সমাধানের দিকে নয় সমস্যার দিকেই এগুচ্ছে


প্রথমেই বলে রাখি, আমি ভালো লিখিয়ে নই। নীরবে পড়ে যাওয়াই আমার কাজ। এদ্দিন সেটাই করেছি, এমনকি নিজের প্রোফাইলেও আমি মোটেই স্ট্যাটাস দেইনা বললেই চলে। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে লিখতে বাধ্য করেছে তাই আমার দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু কথা লিখলাম।


ব্যপারটা এমনই হয়ে আসছে, আমরা বাঙ্গালীরা একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে আছি। আমাদের রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ভালোবাসা, পছন্দ, অপছন্দ, এমনকি আদর্শিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস পর্যন্ত, সবকিছুই কোন প্রভাবক ছাড়া তুঙ্গে উঠে না। তাই আমাদের জেগে ওঠা বা ঘুমিয়ে থাকা, সবই আমরা করে থাকি অন্যের স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের নিজেদের কোন চিন্তার স্বাধীনতা নেই, সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হলো আমরা আমাদের নিজস্ব মগজ, জ্ঞান, ও বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করার মতো বুদ্ধিমান হতে পারিনি। আমরা আবহমান কাল ধরে অথর্বই রয়ে গেলাম। আমরা যদি একেবারে সোজা সাপ্টা চিন্তা করি তাহলে কি দাঁড়ায়? একজন সাদা মনের মানুষ ভালো কে ভালবাসবেন এবং মন্দকে ঘৃণা করবেন। উদারতা বা মহানুভবতা, যা আমরা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে পড়েছি, সেগুলোর প্রায়োগিক দিক গুলো কোথায়? উদারতা ও মহানুভবতা কি এই নয় যে একজন সুন্দর মনের মানুষের মধ্যে শুধু পাপকে ঘৃণা করার জন্যেই ঘৃণা থাকবে, এবং ভুলকারিকে তার পরবর্তীতে ক্রমানুসারে ভালো কাজ করে যাওয়ার দরুন অতীতের জন্যে ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নেয়ার জন্য মহানুভবতা থাকবে। একজন সাদামনের মানুষ ঘৃণার অনল উদগীরনের চাইতে ভালোবাসা ও ক্ষমার দৃষ্টান্ত দেখাতে সচেষ্ট হবেন। সৎ মানুষ মাত্রেই একজন মানুষ মিথ্যার বেসাতিতে বসবাস না করে মিথ্যাকে বয়কট করবেন যদিওবা সেটা নিজের গোত্রের স্বার্থ বিরুদ্ধ হয়। সাদা-কালো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর চেয়ে সহজ কথা আর হতে পারে না, বরং এটাই সার্বজনীন। কিন্তু বই পুস্তকের এই মহান মহান শিক্ষাগুলোর ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ কই? সামাজিক প্রয়োগ কই? এবং এগুলোর জাতীয় জীবনের প্রয়োগ কই?


এখন যে দেশে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এমন এক কিম্ভুতকিমাকার পরিস্থিতিতে আমাদের ন্যায়ের পক্ষপাতিত্ব কোথায়? আমাদের নিজস্ব মগজ, জ্ঞান, ও বুদ্ধি প্রসূত চিন্তা চেতনা কোথায়? কোথায় আমাদের ভালো কে ভালোবাসা? কোথায় আমাদের মন্দকে ঘৃণা করা? কোথায় আমাদের প্রতিপক্ষকে বুকে টেনে নেয়ার মতো মহানুভবতা? কোথায় মিথ্যাকে সর্বময় বয়কটের সাহসিকতা? আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের কোথাও কি এসব বিন্দুমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে? তাহলে আমরা জাতি হিসেবে কি নিয়ে গর্ব করবো? কি আছে আমাদের? কেন আমাদেরকে সত্যের পক্ষে আপোষহীন জাতি হিসেবে গণনা করা হবে?


এই সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় যে ইস্যুটি সকলকে একপ্রকার মহা উন্মাদে পরিণত করেছে সেটি হল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁশির দাবী। কি পক্ষ আর কি বিপক্ষ, কাউকেই সঠিক ভাবে আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে আমরা নাকি জেগে উঠেছি, দেশে না কি গন জোয়ার এসেছে। কিন্তু জেগে থাকা মানুষতো নুন্যতম কিছু চিন্তা-ফিকির করে, যৌক্তিক দিক গুলোকে জেগে থাকা মানুষের পক্ষে কিছুতেই এড়িয়ে গোয়ারের মতো সামনে ছুটে চলা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধ যদি হয়েই থাকে তাহলে এর বিচার অবশ্যই বাংলার মাটিতে হতে হবে কিন্তু বিবেকবানদের জন্য খটকাটা তো গোড়াতেই রেখে দিয়েছেন সরকার। যুদ্ধাপরাধ তারা মুখে মুখে বললেও কাগজে কলমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলে চালাচ্ছেন। এই খটকাটাকে আরও ঘনীভূত করা হচ্ছে জায়গায় জায়গায় মানবতা বিরোধী অপরাধ বলে প্রচার করে। প্রশ্ন হলো কেন এই ধোঁয়াশা? হুজুগে বাঙ্গালীর অধিকাংশই হুজুগে দৌড়লেও মগজ দিয়ে চিন্তাকরার লোক যে একেবারে নেই তা তো নয়।


নির্ভরযোগ্য ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত আইনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনটির ব্যপারে ডজন খানেক অসংগতির ব্যপারে আপত্তি আসলেও সরকার কোন তোয়াক্কা করলো না, এমনকি মাওলানা আবুল কালাম আজাদের রায়ে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়ে গেলো এই আইনে। এর পর যখন কাদের মোল্লার রায় এলো, জামাতের আন্দোলনে বিচারক গন প্রভাবিত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠলো এবং অন্যদিকে জামায়াত সে রায়কে প্রত্যাখ্যান করলো। মুখোমুখি দুই পক্ষই আদালতের বিপক্ষে স্থান নেয়ায় সরকার সেই আইন পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লাগলো। এই যখন অবস্থা তখন যাদের মাথায় বিন্দু মাত্র চিন্তা শক্তি সম্পন্ন মগজ আছে অর্থাৎ যারা আবেগ দিয়ে নয় বরং মগজ দিয়ে চিন্তা করেন তাদের কাছে একটা ব্যপার স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে ট্রাইব্যুনাল, বিচারক এবং সরকার নিশ্চয় একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নে একই পথে হাঁটছে। দেশের টেলিভিশন গুলোতে অনেক বরেণ্য আলোচক, আন্তর্জাতিক আইন বেত্তারা, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান এ বিবাদী পক্ষ থেকে যখন একের পর এক আইন পুনর্ঘটনের দাবী আসলো তখন সরকার, মিডিয়া ও বাম নেতৃবৃন্দ তা কানে তুললেন না। কিন্তু যখনই একটি রায় নিজেদের স্বার্থ বিরুদ্ধ হয়ে গেলো তখনই স্বল্প নোটিসে সেই আইনটিই পরিবর্তনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো সরকার। নির্বোধ, জ্ঞান পাপী ও হীন স্বার্থান্বেষী ছাড়া বিবেকবান সকলেরই এ ব্যপারে প্রশ্ন জাগবে।


স্কাইপি কেলেঙ্কারির কথা না বললেই নয়, যখন দেখা গেলো স্কাইপি কেলেঙ্কারিতে ফাঁস হওয়া নথিপত্রের সাথে আদালতের বিভিন্ন সময়ে নেয়া পদক্ষেপ হুবহু মিলে গেছে তখন এখানে সন্দেহ জাগাটা খুবই যৌক্তিক যে ট্রাইব্যুনাল অসৎ শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। কিন্তু শুধুমাত্র ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানকে সরিয়েই এই দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টা সাধারণ মানুষের কাছে অযৌক্তিক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, বরং এটা হওয়া উচিৎ।


এদিকে প্রতিটি মামলার সাক্ষীসাবুদ ও শুনানি গুলো যারা নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা ট্রাইব্যুনালের পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার হাজারটা অজুহাত পেয়ে যাবেন। পাশাপাশি রয়েছে বিবাদী পক্ষের সাক্ষীকে অপহরণ, ঘটনার কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকা, শোনা কথার উপর রায় দেয়া এভাবে রন্দ্রে রন্ধ্রে অসংগতি থাকা সত্বেও কিভাবে মানুষ এই রায়কে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়? এরকম মানুষ গুলো জাতিগত ভাবে কোন পর্যায়ে পড়ে? মানসিক ভাবে এরা কতটা সুস্থ? বুদ্ধিগত দিক দিয়ে এরা কতটুকু পরিপক্ব? এই প্রশ্ন গুলো কি আপনার মনে একটুকুও আঘাত করে না? যদি না করে তাহলে কোন প্রকারের মানুষ আপনি?


যারা ন্যায় বিচার চান তারা কখনই শাস্তি কি হতে হবে তা আগে নির্ধারণ করেন না, তারা চান আগে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ হোক, তারা এও চান যে অপরাধ প্রমাণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও যৌক্তিক হোক। অপরাধ প্রমানিত হওয়ার আগে অভিযুক্তকে অপরাধী বলাটাও কোন সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন মানুষের কাজ নয়। আজকে যারা শাহবাগে ফাঁশির দাবী নিয়ে দন্ত-নখর হীন বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালকে প্রভাবিত করছেন এরা নিঃসন্দেহে ন্যায় বিচার চান না। যারা ন্যায় বিচার কামনা করেন তারা কখনই এমন আচরণ করেন না। তারা কখনই শাস্তি কি হবে তা নিয়ে আগে-ভাগে চিন্তিত হন না বরং তারা সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে অপরাধ প্রমাণের পরেই সঠিক শাস্তিটি দেয়া হল কিনা তা নিয়ে চিন্তা করেন।


শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জড়ো হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত উত্থাপিত দাবী গুলোর দিকে তাকিয়ে কি বিবেকবান মানুষদের মনে একবারও প্রশ্ন জাগে নি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পেছনে আর কোন মোটিভ কাজ করছে কি না? যাদের ডাকে শাহবাগের আন্দোলনে মানুষগুলো গেলো এদের পরিচয় জেনেও কি কারও মনে প্রশ্ন জাগে নি যে এরা আসলে কি চায়? এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা আসিফ মহিউদ্দীন একজন স্বঘোষিত নাস্তিক, যিনি ইসলাম ধর্ম, নবী মুহাম্মদ (স) ও আল্লাহকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন ব্লগের পাতায় পাতায়। অমি রহমান পিয়াল, যিনি বাংলায় পরিচালিত সবচেয়ে বড় পর্ণ সাইট যৌবনযাত্রার একজন পরিচালক, আসিফ মহিউদ্দীনেরই আরেক সহচর তামান্না ঝুমু, ইব্রাহীম খলিল যিনি সবাক নামে ব্লগ লিখেন তিনিও ইসলাম, আল্লাহ, কুরআন ও নবী রাসুল নিয়ে অসংখ্য কুরুচিপূর্ণ ব্লগ লিখেছেন, এছাড়া আছেন আরিফুর রহমান, টেলিসামাদ (ব্লগ নিক), বাকরুদ্ধ (ব্লগ নিক) নামের নাস্তিক ও চরম ভাবে ইসলাম বিদ্বেষী ব্লগার একটিভিষ্টদের নেতৃত্বে চলছে শাহবাগ। মধ্যবয়সী বিপ্লব নামের এক ভদ্রলোক “শয়তান” নিকে ইসলাম নিয়ে লিখেছেন অনেক আপত্তিকর পোষ্ট, এছাড়া “মেঝছেলে”, ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান, ছন্নছাড়া, জেবতিক নামের সুপরিচিত ব্লগার ও সাংবাদিকরা বছরের পর বছর ইসলামের বিরুদ্ধে চরম আপত্তিকর লেখালেখি করে এসেছেন। আজ তাদেরই ডাকে আমরা শাহবাগে উষ্মাদের মতো ছুটে চলেছি।


এতো এতো অসংগতি শাহবাগ ও তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সাথে লেপটে আছে যে একটি নোট লিখে তা সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু যারা আবেগ দিয়ে নয় মগজ দিয়ে চিন্তা করেন অর্থাৎ যাদের মাথায় নুন্যতম পরিমাণে ঘিলু আছে তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন থেকে গেলো এতকিছুর পরেও কি একবার আপনি ভেবে দেখবেন না যে চল্লিশ বছর ধরে ঘৃণার বীচ ছড়িয়ে মূলত আমাদের কি লাভ হয়েছে এবং কি লাভ ভবিষ্যতে হবে? এর চেয়ে কি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহনশীলতাই উপযুক্ত সমাধান নয়? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিধর্মীদের, তসলিমা নাসরিন ও হুমায়ুন আজাদদেরকে বাঁচাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবক দেন, ধর্মনিরপেক্ষতার বড়ি খাওয়াতে মুক্তচিন্তার কথা বলেন কিন্তু জাতীয় ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কেন শাহবাগ থেকে, টিভি চ্যানেল থেকে, নাটক সিনেমা থেকে শুধুই ঘৃণা ছড়ান, উত্তেজনাকে উস্কে দেন, আপনার বিবেকে কি এই প্রশ্ন জাগেনি কোনদিন? আপনার মনে কি এই প্রশ্ন জাগেনি যে ঘৃণাকে পুঁজি করে ইতিহাসে কোন জাতি কবে কখন কিভাবে উন্নতি করেছিলো?


দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে আমাদের কি একটি মধ্যপন্থি, মডারেট ও উদার মানসিকতা সম্পন্ন জনতার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিৎ নয়? আমি শুধু প্রশ্নগুলো রেখে গেলাম, সিধ্যান্ত আপনাদের। আমার তাই মনে হচ্ছে শাহবাগ কোন সমাধানের দিকে নয় বরং সমস্যার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।


প্রচন্ড গালির বন্যায় উড়ে যাবো, লোকে "তুই রাজাকার" বলবে জেনেও আমি যা মনে করি তাই লিখে গেলাম।

লেখাটি লিখেছেনঃ Ahad M Nizam
collected from  https://www.facebook.com/newbasherkella

No comments:

Post a Comment