Wednesday, February 1, 2012

ঘুমানো এবং জাগ্রত হওয়ার আদব


লেখকঃ হাসানুল কাদির

ঘুম আল্লাহ তায়ালার একটি বিশাল নেয়ামত, এর মাধ্যমে তিনি নিজ বান্দাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। এবং তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। নেয়ামতের দাবি হল শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন :

তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন যাতে তোমরা রাতে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:

তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী।
দিনের ক্লান্তিকর চলাফেরার পর রাতে শরীরের প্রশান্তি শরীর সুস্থ থাকাকে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে শরীরের বর্ধন এবং কর্ম চাঞ্চল্যতেও সাহায্য করে। যাতে করে ঐ দায়িত্ব পালন করতে পারে যার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে সৃষ্টি করেছেন।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যা কিছু অতি জরুরি ঘুম তার অন্যতম। মুমিন বান্দা যদি ঘুমের মাধ্যমে দেহ ও মনকে আরাম দেওয়ার নিয়ত করে, যাতে করে সে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের বিষয়ে আরো দৃঢ় হতে পারে। অতঃপর ঘুমের সমস্ত সুন্নত ও শরয়ি আদব পরিপূর্ণ রূপে পালন করার চেষ্টা করে, তবে তার ঘুম এবাদত হিসাবে পরিগণিত হবে এবং সে পুণ্য লাভ করবে।

সাহাবি মুআয বিন জাবাল (রা) বলতেন ―
আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং জাগ্রত হয়ে সালাত আদায় করি, জাগ্রত থেকে সালাত আদায়ের মাধ্যমে যেভাবে ছওয়াবের আশা করি ঠিক তেমনি করে ঘুমানোর মাধ্যমেও ছওয়াবের আশা করি ।

ইবনে হাজার (র) বলেন, এর অর্থ হল: তিনি আরামের ভিতর পুণ্য আশা করতেন যেমন কষ্টের ভিতর আশা করতেন।

কেননা, আরামের উদ্দেশ্য যদি এবাদত করার জন্য সাহায্য সঞ্চয় করা হয়, তবে সে আরামের দ্বারা পুণ্য হবে। এখানে মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) এর জাগ্রত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হল রাতের নামাজ।

ঘুমের কতিপয় আদব এবং বিধান
(১) অধিক রাত জাগরণ না করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার নামাজের পূর্বে ঘুমানো এবং নামাজের পর অহেতুক গল্প-গুজব করাকে খুব অপছন্দ করতেন ।

কিন্তু ভাল ও নেক কাজের জন্য এশার পরে জাগ্রত থাকাতে কোনো ক্ষতি নেই। যেমন মেহমানের সাথে কথা বলা অথবা ইলমি আলোচনা করা অথবা পরিবারকে সময় দেওয়া ইত্যাদি। মোটকথা, যে জাগ্রত থাকা কোনো ক্ষতির কারণ হবে না যেমন ফজরের নামাজ নষ্ট হয়ে যাওয়া, সে জাগ্রত থাকাতে কোনো ক্ষতি নেই।

তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপকারিতা
ক) সুন্নতের অনুসরণ।
খ) শরীরকে আরাম দেওয়া, কেননা দিনের ঘুম রাতের ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে পারে না।
গ) ফজরের নামাজের জন্য খুব সহজে এবং পূর্ণ শক্তি ও চাঞ্চল্যতার সাথে জাগ্রত হওয়া যায়।
ঘ) তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য শেষ রাতে জাগ্রত হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির এটি বড় সহায়ক ।
২। প্রত্যেক মুসলমানকে সব সময় ওযু অবস্থায়ই ঘুমাতে চেষ্টা করা উচিত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবনে আযেব (রা) কে বলেছিলেন―
যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাজের ওজুর মত ওজু করবে।
৩। ডানদিকে পাশ ফিরে ঘুমাবে।

৪। উপুড় হয়ে ঘুমানো মাকরূহ। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―
এটি এমন শয়ন, যাকে আল্লাহ তায়ালা খুব অপছন্দ করেন।

৫। ঘুমানোর সময় হাদিসে বর্ণিত জিকির-আজকার ও দোয়া থেকে সাধ্যানুযায়ী পড়ার চেষ্টা করবে। জিকির তথা আল্লাহর নাম নেয়া ব্যতীত ঘুমানো মাকরূহ।

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত―
যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির ছাড়া শুয়ে পড়বে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আক্ষেপের বিষয় হবে।
হাদিসে বর্ণিত (ঘুমানোর সময়ের) কিছু দোয়া

ক) আয়াতুল কুরসি পড়া।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমজানের ফিতরা সংরক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। কোনো এক আগন্তুক আমার কাছে আসল, এবং অঞ্জলি ভরে খাবার (চুরি) সংগ্রহ করতে লাগল।... এরপর পূর্ণ হাদিস বর্ণনা করেন। -তাতে আছে- আগন্তুক তাকে বলল : তুমি যখন তোমার বিছানায় যাবে তো আয়াতুল কুরসি পড়বে, কেননা এর মাধ্যমে সর্বক্ষণ তোমার সাথে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একজন হেফাজতকারী থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে ঘেঁসতে পারবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমাকে সত্য বলেছে অথচ সে বড় মিথ্যাবাদী। সে হচ্ছে শয়তান।
খ) সুরা এখলাস, সুরা ফালাক এবং সুরা নাস পড়া।

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রতি রাতে নিজ বিছানায় যেতেন দুই হাতের কবজি পর্যন্ত একত্রিত করতেন অতঃপর তার মাঝে ফু দিতেন এবং সুরা এখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়তেন । অতঃপর দুই হাত যথা সম্ভব সমস্ত শরীরে মলে দিতেন। মাথা, চেহারা এবং শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করতেন। এরূপ পরপর তিনবার করতেন।

গ) আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহয়া’ দোয়াটি পড়া।
অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনার নামে মৃত্যবরণ করলাম এবং আপনার নামেই জীবিত হব।
ঘ) নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়া।

‘আল্লাহুম্মা আসলামতু নাফসি ইলাইকা, ওয়া ফাওয়াযতু আমরি ইলাইকা ওয়া আলজা‘তু যাহরি’ বলা। অর্থাৎ, হে আল্লাহ, আমি নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিয়েছি। আমার বিষয় আপনার কাছে সোপর্দ করেছি। আমার পিঠ আপনার সাহায্যে দিয়েছি আপনার প্রতি আশা এবং ভয় নিয়ে, আশ্রয় নেয়ার ও আপনার শাস্তি থেকে বাঁচার মত জায়গা আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনার অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি এবং আপনার প্রেরিত নবীর প্রতি।

৬। ঘুমের মাঝে অনাকাক্সিক্ষত ও অপছন্দনীয় কিছু দেখলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি কাজ করতে বলেছেন।

ক) বাম দিকে তিন বার থুতু ফেলবে।
খ) ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ বলে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাইবে।
গ) এ স্বপ্নের কথা কাউকে বলবে না।
ঘ) যে কাতে শোয়া ছিল সে কাত থেকে ঘুরে শোবে অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শোবে।
ঙ) নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (র) এ পাঁচটি কাজ উল্লেখ করে বলেন : যে এই কাজগুলো করবে খারাপ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না বরং এ কাজ তার ক্ষতি দূর করে দেবে।
৭। সন্তানদের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে তাদের বিছানা আলাদা করে দেয়া একান্ত আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে নামাজের আদেশ দাও যখন তাদের বয়স সাত বছর হবে এবং এর জন্য তাদেরকে শাস্তি দাও যখন তাদের বয়স দশ বছর হবে এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।

৮। মুসলমান অবশ্যই সর্বদা ফজরের নামাযের পূর্বে জাগ্রত হবে যেন নামাজ সময়মত জামাতের সাথে ঠিকভাবে আদায় করতে পারে। এ ব্যাপারে চেষ্টা করা এবং এতে সহায়তাকারী উপকরণাদি গ্রহণ করা তার জন্য ওয়াজিব।

এক ব্যক্তি ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল তার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হল। রাসূল বললেন : ঐ ব্যক্তির কর্ণ-দ্বয়ে শয়তান প্রস্রাব করে দিয়েছে।
৯। মুসলমান ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর নিম্নোক্ত দোয়া পড়া
মুসতাহাব :

আল হামদু লিল্লাহিল্লাযি আহয়ানা বা‘দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর।

সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে মৃত্যু দেয়ার পর জীবিত করে দিয়েছেন এবং তার কাছেই ফিরে যাব।

সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্লর জন্য যিনি আমার আত্মাকে আমার নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন, আমার শরীরকে সুস্থ রেখেছেন এবং আমাকে তার স্মরণের অনুমতি দিয়েছেন।
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুকরণে মিসওয়াক করবে।

No comments:

Post a Comment